Sunday, April 17, 2022

Manusamhita

 অমানবিক ব'লে কুখ্যাত মনুসংহিতা প্রকৃতার্থে উদারভাবনা ও মানবিকতার এক সোপান - একটি বিশ্লেষণ 

.........................................................................


প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রসমূহের মধ্যে সর্বাধিক বিতর্কিত এবং নিন্দিত নিঃসন্দেহে মনুসংহিতা l চরম জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য যেমন এই গ্রন্থখানিতে প্রশ্রয় পেয়েছে তেমনই বিস্তার লাভ করেছে নারীবিদ্বেষ l অসংখ্য শ্লোকে মনুসংহিতায় প্রতিফলিত নির্মম নিদারুণ অমানবিক বিধান l প্রাচীন হিন্দুসমাজ ছিল সামাজিকভাবে উচ্চনীচ জাতিবিভাজনে বিভক্ত এবং লিঙ্গবৈষম্যময় - মনুসংহিতাই এর সবথেকে বড় প্রমাণ l এই ধারণাকে মান্যতা দিয়ে রচিত হয়েছে কয়েক সহস্র রচনা l  স্বয়ং বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর মনুসংহিতা পড়ানো হয়, যেটি "মনুস্মৃতি দহন দিবস" নামে পরিচিত l এটি ছিল একটি প্রতীকি প্রতিবাদ হিন্দু সমাজের অন্তর্নিহিত অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে এবং এই বিশ্বাস থেকে যে  উচ্চনীচ জাতিবিভাজনের ভরকেন্দ্র ন্যস্ত মনুসংহিতায় l চরম ব্রাহ্মণ্যবাদ, শূদ্রবিদ্বেষ সাথে কঠোর পিতৃতান্ত্রিকতা এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য হওয়ায় স্বাধীন ও উদারপন্থীগণের একাংশের নিকটে এই গ্রন্থখানি একপ্রকার বিষস্বরূপ l "মনুসংহিতা সর্বনাশা" এরকম একটি ধারণা সমাজের একাংশের মধ্যে আমূল প্রোথিত l 'মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতা অ-মানবিক ' - চূড়ান্ত এক আত্মবিরোধিতা, যা এক রহস্য! এই রহস্যের উন্মোচনে আমাদের প্রবেশ করতেই হবে তথাকথিত নিষিদ্ধ গ্রন্থ মনুসংহিতায় l এই পথ দীর্ঘ এবং কুয়াশাচ্ছন্ন l পূর্বস্বীকৃতিশূন্য, যুক্তিনিষ্ঠবিচার কেবল আমাদের পথ দেখাতে পারে l অন্যথায় আমরা পথভ্রষ্ট হবো কৃতিবিকৃতির কুয়াশাঘেরা পথে l নিষিদ্ধ গ্রন্থের অন্দরে প্রবেশের অদম্য কৌতূহল এবং পুনঃবিচারের আকাঙ্খা পাঠক যদি অন্তরে একান্তই অনুভব করেন, দীর্ঘ এই পথের সহযাত্রী তিনি হতেই পারেন l


প্রাচীনভারতে একাধিক মনুর উল্লেখ আছে l শাস্ত্রকার ও ইতিহাসবিদদের মতে "মনুসংহিতা" -য় উল্লিখিত মনু হলেন স্বয়ম্ভুব মনু l মহাভারতেও মনুসংহিতার উল্লেখ আছে l (Bhandarkar, পৃ ৫১-৫৭)  মনুসংহিতা অতি প্রাচীন এবং স্মৃতিসমূহের মধ্যে এটি প্রধান এবং প্রাচীনতম l পরবর্তী পর্যায়ে মহর্ষি ভৃগু এবং তাঁর শিষ্যগণ মনুসংহিতা ( মনুবাক্য ) সংযোজিত এবং বর্ণিত করেন l (মুখোপাধ্যায় উপেন্দ্রনাথ, মুখবন্ধ  )  মনুষ্য জীবনের ব্যবহারিক এবং আধ্যাত্মিক প্রায় সকল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশকে ছুঁয়ে গেছে মনুসংহিতা l সমাজে নারীর স্থান (অধিকার ও স্বাধীনতা),  বর্ণ ও বর্ণব্যবস্থা, দন্ডনীতি, নীতিনৈতিকতা, সামাজিক সাম্য ও স্বাধীনতা মূলত: এইসকল বিষয়ে আমরা সীমাবদ্ধ থাকবো l কারন এই সকল বিষয়কে কেন্দ্র করেই মনুসংহিতার যাবতীয় বিতর্ক ও নিন্দার ঝড় l


লিঙ্গবৈষম্য এবং নারীবিদ্বেষ মনুসংহিতার বিরুদ্ধে অতি প্রচলিত এবং প্রধান একটি অভিযোগ l বাস্তবে, মনুসংহিতায় নারীর স্থান অতিউচ্চে l ব্যবহারিক হতে আধ্যাত্মিক, জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার মনুসংহিতায় স্বীকৃত l এ সম্পর্কে মনুসংহিতার নিম্নরূপ বিধান প্রণিধানযোগ্য l


* নারীর সম্পত্তির অধিকার


বন্ধ্যা স্ত্রী, পুত্রহীনা, প্রোষিতভর্তৃকা, সপিন্ড রহিতা, প্রতিব্রতা, বিধবা ও রোগিনী এদের ধন অনাথ বালকের ধনের মতোই রাজা রক্ষা করবেন l (মনু: ৮/২৮)


ধনবিভাগের সময়ে যদি অবিবাহিতা ভগিনী থাকে, প্রত্যেক ভ্রাতা নিজ নিজ অংশ থেকে চারভাগের এক ভাগ অংশ অবশ্যই দেবে l যিনি এই দানে অনিচ্ছুক, সে ধর্মত: পতিত হবে l (মনু : ৯/১১৮)


যেমত আত্ম ও পুত্রেতে প্রভেদ নেই, সেইরূপ পুত্রের সমান  দুহিতা ; অতএব পিতার আত্মস্বরূপ পুত্রিকা মৃত অপুত্রক ব্যক্তির ধন গ্রহণ করবে l ( মনু : ৯/১৩০)


মাতার যে ধন তা তার কুমারী কন্যারই প্রাপ্য l পুত্রহীনের যে ধন তা তার দৌহিত্রের প্রাপ্য l (মনু : ৯/১৩১)


স্ত্রীধন (নারীর সংরক্ষিত ধন ) -এর সাহায্যে পরিবারের পুরুষের জীবিকা নির্বাহ কিম্বা আমোদ-বিহারে খরচ নিন্দিত কর্মরূপে বিবেচ্য l (মনু : ৩/৫২)


উপরিউক্ত বিধানগুলি থেকে স্পষ্টতই এটা প্রতীয়মান হয় যে, মনুসংহিতা অনুযায়ী নারীদের সম্পত্তির উপর পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং তা যেন সতর্কতার সাথে রক্ষিত হয়, সেই হেতু উপযুক্ত বিধানও রয়েছে l 'নারীর সম্পত্তিতে নারীরই অধিকার' - একথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে l ক্ষেত্র বিশেষে পুত্র অপেক্ষা কুমারী কন্যার সম্পত্তির অধিকারকে অধিকতর মান্যতা দেওয়া হয়েছে l আরও লক্ষ্যণীয়, পুত্র ও কন্যা - উভয় সন্তানকে সমজ্ঞান করা হয়েছে l


(* অপুত্রক ব্যক্তি কন্যাসম্প্রদান কালে  - 'এই কন্যাতে যে পুত্র জন্মাবে সে আমার শ্রাদ্ধপিন্ডের অধিকারী হবে'', এমন অঙ্গীকার করলে, সেই কন্যাকে বলা হয় পুত্রিকা ) (মনু : ৯/১২৭)


* নারীর শিক্ষার অধিকার


মনুসংহিতায় নারীগণের নিকট হতে শিক্ষা অর্জনের বিধানও আছে l  বৈদিক সমাজে নারীদের শিক্ষাগ্রহণের পূর্ণ অধিকার ছিল l বেদের মন্ত্রদ্রষ্ট্রা ঋষিদের মধ্যে মহিলা ঋষিও রয়েছেন(ঋষিকা )। অথর্ববেদ বলেছে, “ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।” (১১.৫.১৮) এই বিধানের নিহিতার্থ এই যে, একজন  যুবক যেমন ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদ্বান যুবককে স্বামীরূপে গ্রহন করবে। স্পষ্টতই শিক্ষা অর্জনে কোন লিঙ্গবৈষম্য করা হয়নি l বৈদিক সমাজে নারীগণ শিক্ষাদানও করতেন (বন্দ্যোপাধ্যায় (ড:) উদয়চন্দ্র, পৃ: ৫২ - ৫৫)  শ্রী অমর্ত্য সেন তাঁর ' The Argumentative Indian' গ্রন্থে বৈদিক সমাজে নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকার বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন l (সেন অমর্ত্য, পৃ: ৭ - ৯ )


* নিজ বিবাহ বিষয়ে নারীর স্বাধীনতা


গুণহীন পাত্রে কন্যাদান অপেক্ষা আমৃত্যু কন্যার পিতৃগৃহে বসবাস শ্রেয় l (মনু সংহিতা: ৯/৮৯)


কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে নিজের সদৃশ পতি নিজেই মনোনীত করতে পারে l (মনু : ৯/৯০)


পিতা যদি কন্যা দান না করে, কন্যা নিজেই যদি পতি বরণ করে নেয়, তাকে বা তার পতিকে কোন পাপই স্পর্শ করেনা l (মনু : ৯/৯১)


বিধানগুলি থেকে স্পষ্ট যে, স্বামী নির্বাচনে নারীর স্বাধীনতা স্বীকৃত , সেই সাথে ক্ষেত্রবিশেষে ( উপযুক্ত গুণযুক্ত পাত্রের অভাবে ) নারীর অবিবাহিত থাকার অধিকারকেও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে l


*  নারীর পুনর্বিবাহে অধিকার


স্বামী ধর্মকার্যের জন্য বিদেশে গেলে তার জন্য আট বৎসর প্রতীক্ষা করবে, বিদ্যার জন্য গেলে ছয় বৎসর, যশ অর্থ বা কামোপভোগের জন্য গেলে তিন বৎসর প্রতীক্ষা করবে l (মনু : ৯/৭৬)


স্বামী পরিত্যাক্তা বা মৃতভর্ত্তৃকা যে নারী স্বেচ্ছায় অন্যপুরুষের ভার্যাত্ব স্বীকার ক'রে নিয়েছে, তার গর্ভে উৎপাদিত পুত্র উৎপাদকের পৌনর্ভব পুত্র বলে পরিচিত হবে l ( মনু : ৯/১৭৫)


বিধানদুটি জানান দেয়, মনুসংহিতা ক্ষেত্রবিশেষে নারীর পুনর্বিবাহ সমর্থন করে l স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছেন, "... Manu, Vishnu, Yajnavalkya and Vasishtha, have admitted the remarriage of a woman, on the degradation, impotence, insanity, or the death, of her husband.' ( বিদ্যাসাগর, পৃ : ৭১) রামায়ণ এবং মহাভারতে বিধবাবিবাহের উল্লেখ আছে l (ঐ ) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মতেও ক্ষেত্রবিশেষে নারীর বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ এবং বিধবাবিবাহের অধিকার ছিল l (ড: অনিল চন্দ্র বসু, পৃ :১৫-১৭) বেদে বিধবা বিবাহ সমর্থনীয় l (বন্দোপাধ্যায় (ড : উদয়চন্দ্র , পৃ : ৫৪)


গ ) সংসারে নারীর শেষ্ঠত্ব


সহস্র পিতার চেয়ে একজন মাতার গৌরব বেশি l (মনু : ২/১৪৫)


যে পরিবারে নারীগণ সম্মানিত, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন থাকেন; যেখানে নারীগণের সমাদার নেই, সেখানে যজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্ম সমস্তই ব্যর্থ হয়ে যায় l (মনু: ৩/৫৬)


যে পরিবারের নারীগণ সর্বাদাই দুঃখিত সেই কুল বিনষ্ট হয়, অন্যদিকে যে পরিবারে নারীগণ সুখী সেই কুলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে l (মনু : ৩/৫৭)


স্ত্রী গৃহের মহোপকারিণী, দীপ্তিস্বরূপা, পূজারযোগ্যা l সুতরাং, গৃহে শ্রী এবং স্ত্রী - এদের কোন পার্থক্য নেই l (মনু: ৯/২৬)


আলোচ্য প্রতিটি বিধান বলে দেয়, মনুসংহিতার সমাজরূপায়ণে নারীর মর্যাদা উচ্চাসনে এবং সেইসাথে প্রতিটি সংসারে নারী যেন কোনভাবে বঞ্চিত বা অবদমিত না হয়, সেই সতর্কিকরণ বিধানও আছে  l


মনুসংহিতার বিরুদ্ধে অপর একটি প্রধান অভিযোগ জাতিবিদ্বেষবাদ, যা জন্মভিত্তিক উচ্চনীচ বর্ণবিভাজনকে মান্যতা দিয়ে সামাজিক অসাম্যতাকে প্রশ্রয় দেয় l বাস্তবে মনুসংহিতা ঠিক এর বিপরীত l মনুসংহিতা জাতিবিভাজনের চরম বিপক্ষে এবং সর্বোচ্চভাবে সামাজিক সাম্যতার পক্ষে l আমরা ধাপে ধাপে মনুসংহিতার বিধান উল্লেখ পূর্বক বক্তব্য বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করবো l 


*  বর্ণ ও বর্ণব্যবস্থা


মনুসংহিতায় "বর্ণ" ও "বর্ণব্যবস্থা"  বলতে কি বোঝায় তা  অনুধাবনের চেষ্টা করা যাক l মনুসংহিতা বলছে,


শূদ্র যেমন ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে তেমন একইভাবে ব্রাহ্মণেরও শূদ্রতা লাভ হয় এবং ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্বন্ধেও একইরূপ জানতে হবে l (মনু : ১০/ ৬৫)


বিধানটিতে স্পষ্টতই  বর্ণব্যবস্থা কর্মভিত্তিক একথা বলা হয়েছে l কর্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থা ব্যক্তির গুণপ্রসূত, কোন কুলে ব্যক্তির জন্ম তার কোন তাৎপর্য এখানে নেই l এই বর্ণব্যবস্থা গ্রহণমূলক ( inclusive) l ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণ বা যোগ্যতা হেতু তার কর্ম নির্ধারিত এবং তদানুযায়ী বিশেষ বর্ণে চিহ্নিত l কর্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থায় যোগ্যতার ভিত্তিতে এক বর্ণ হতে অন্য বর্ণে পরিবর্তিত হওয়া যায় এবং সেটাই নিয়ম l (Nadkarni.M. V. )  ব্রাহ্মণ কুলজাত ব্যক্তি শূদ্র (বা অন্য বর্ণে ) পরিবর্তিত হতে পারে, আবার শূদ্র কুলজাত ব্যক্তি ব্রাহ্মণ ( বা অন্য বর্ণে ) পরিবর্তিত হতে পারে l  যেমন পরাশর মুনির ঔরসজাত শূদ্রানারী সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তান স্বয়ং মহর্ষি বেদব্যাস l সামাজিক পরিচয়ে যিনি ছিলেন 'পারশব' l ( শ্রী মুরারিমোহন শাস্ত্রী) আবার,  পারশব ব্যাসদেবের ঔরসজাত হস্তীনাপুর অন্তঃপুরের এক দাসীর সন্তান মহামতি, মহাজ্ঞানী, মহামন্ত্রী বিদুর l সামাজিক পরিচয়ে যিনি ছিলেন 'পুক্কস' l (ঐ ) এ প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লিখিত ঋষি সত্যকাম, যিনি ছিলেন পিতৃপরিচয়হীন এবং তাঁর মাতা জবালা ছিলেন একজন দেহোপোজীবিনী l মহাঋষি বাল্মীকিও ছিলেন কুলপরিচয়ে শূদ্র l আরও অনেক বৈদিক ঋষি আছেন যাঁরা শূদ্র গর্ভজাত বা বংশপরিচয়ে শূদ্র l প্রাচীন ভারতের বহু রাজা ছিলেন শূদ্র, যাঁরা পরবর্তী সময়ে বর্ণে ক্ষত্রিয় হয়েছিলেন l (Kotiyal.H. S.) l আবার, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হতে শূদ্র হওয়ার কাহিনীও আছে l অপরদিকে, জন্মভিত্তিক জাতপ্রথা বিভাজনমূলক (exclusive ) এখানে কুলদ্বারা বর্ণ নির্দিষ্ট হয় এবং বর্ণান্তরিত হওয়ার সুযোগ নেই l জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথাই কঠোর জাতিপ্রথার ধারক ও বাহক l আলোচ্য বিধানে শাস্ত্রকার মনু গুণপ্রসূত কর্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছেন, যা মানবিক এবং যৌক্তিকভাবে কাম্য l এই ব্যবস্থা  জাতিরূপে মানুষের মধ্যে কোনরূপ ভিন্নতা তথা উচ্চ-নীচ বিভাজন স্বীকার করেনা l ঋষি ভরদ্বাজের চিন্তায় এবং ভবিষ্যপুরাণে জাতিরূপে  সকল মানুষের অভিন্নতা স্বীকার করা হয়েছে l  (সেন অমর্ত্য , পৃ: ১১) l বর্ণ এবং জাতি - এই দুইটি ধারণাগত দিক হতে  সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র l প্রথমটি গুণপ্রসূত ( merit based ) কর্মভিত্তিক,  দ্বিতীয়টি জন্মভিত্তিক ( birth based) l বর্ণব্যবস্থায় গুণভিত্তিক কর্মের নিরিখে একেকজনের  বর্ণ চিহ্নিত কিন্তু মানুষরূপে সকলেই একই জাতি (মানুষ জাতি) এর অধীন l এ সম্পর্কে বিশেষ ভাবে দ্রষ্টব্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ এর চতুর্থ  ব্রাহ্মণের প্রথমাধ্যায়, যেখানে কর্মাধিকারের ভিত্তিতে ( যোগ্যতার নিরিখে ) বর্ণ চিহ্নিতকরণের কথা বলা হয়েছে এবং বর্ণরূপে আত্মাভিমানকারীকে "অবিদ্বান্" বলা হয়েছে l 


মনুসংহিতা আরও বলছে,


ভোজনের নিমিত্তে ব্রাহ্মণ কখনও স্বীয় কুলগোত্রের পরিচয় প্রদান করবে না l ভোজনের জন্য কুল ও গোত্রের পরিচয় প্রদাণ করিলে , পন্ডিতগণ তাকে 'বমনভোজী' বলে থাকেন l (মনু : ৩/১০৯)


এই বিধানে জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথা তথা জাতপ্রথা তীব্ররূপে নিন্দিত হয়েছে l কুলগোত্রের ভিত্তিতে আপন জীবিকা নির্ধারণ এবং পরিচয়দানকে ঘৃণিত কর্ম রূপে বর্ণনা করা হয়েছে l নিছক ব্রাহ্মণকুলে জন্ম হওয়ায় একজন ব্রাহ্মণ বলে চিহ্নিত হবে এবং তদানুযায়ী তার কর্ম নির্ধারিত হবে - এই চিন্তা ও কর্মের বিরুদ্ধে  তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে l উল্লেখ্য, ন্যায়শাস্ত্র প্রণেতা ঋষি গৌতমও তাঁর "ছল" বিষয়ক আলোচনায় 'ব্রাহ্মণ কুলজাত ব্যক্তি মাত্রই ব্রাহ্মণ ' এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন l  (ফনীভূষণ তর্কবাগীশ, পৃ:২৬১)


উপরের দুটি বিধান এবং তার প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ থেকে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, মনুসংহিতা জন্মগত জাতি বা বর্ণপ্রথাকে মান্যতা দেয় না, স্বীকৃতি দেয় কর্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থাকে, যেখানে আপন গুণ (যোগ্যতা ) অনুসারে প্রত্যেকের নিজ কর্ম নির্ধারণ এবং তা পালনের অধিকার রয়েছে l কাজেই মনুসংহিতা উচ্চনীচ বর্ণবিভাজন বা জাতিভেদ প্রথাকে বাস্তবে শুধু অসর্মথনই করে না, চরম নিন্দনীয়রূপে গণ্য করে l


প্রখ্যাত ন্যায়শাস্ত্র পন্ডিত মহামোহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ মহাশয়, তৎপর্য্যটিকা'কার শ্রীমদ্ বাচস্পতি মিশ্র এবং মহাকবি কালিদাসের উক্তি ব্যাখ্যাপূর্বক বলেছেন যে, পূর্বসংস্কারজন্য একেক ব্যক্তি একেক বিষয়ে অনুরাগী হয় l যে বিদ্যায় যার অধিক অনুরাগ জন্মে, সেই বিদ্যাতেই তার অধিক অধিকার জন্মে - ইহা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত l (পৃ : ৩৮-৪৮) শাস্ত্রীয় ভাবনায় সকল কর্মে সকলের অধিকার এবং তা নির্দিষ্ট হবে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণ (প্রবণতা) দ্বারা (  গীতা : ৪/১৩) l এটাই বেদানুমিত কর্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থা l মনসংহিতাও সেই একই কথা বলছে l


* দন্ডনীতি


শাস্তিবিধানের ক্ষেত্রেও মনুসংহিতা পক্ষপাতমূলক l এর বিরুদ্ধে  অভিযোগ যে, সামান্যতম অপরাধে একজন শূদ্রের যেখানে চরম শাস্তির বিধান, অন্যদিকে গুরুতর অপরাধেও ব্রাহ্মণের শাস্তি লঘুতর l অপরাধ ও তার শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রেও মনুসংহিতা শূদ্রের উপর অরিমাত্রায় নির্দয় l বাস্তবে, এই অভিযোগও যথার্থ নয় l এ সম্পর্কে মনুসংহিতার নিমরূপ বিধানগুলি প্রণিধানযোগ্য l


যে অপরাধে সাধারন মানুষের এক পণ দন্ড হবে, রাজা সেই অপরাধ করলে তাঁর দন্ড হবে এক সহস্র পণ l ( মনু : ৮/৩৩৬)


 গুণদোষজ্ঞ শূদ্র যদি চুরি করে, যে দন্ড শাস্ত্র নির্দিষ্ট, তার আটগুণ ঐ শূদ্রের দন্ড হবে, বৈশ্য চোরের দন্ড হবে   ষোলগুণ, এবং ক্ষত্রিয় চোরের দন্ড হবে বত্রিশগুণ l ( মনু : ৮/৩৩৭)


ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে সেই দন্ড হবে চৌষট্টি গুণ, গুণবান ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে সেই দন্ড হবে একশতগুণ, অত্যন্ত গুণবান ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে সেই দন্ড হবে একশত আটাশগুণ l ( মনু: ৮/৩৩৮)


বিধানগুলি হতে এটা স্পষ্টতই প্রতিফলিত হয় যে, ' একই অপরাধে সকলের একইমাত্রায় শাস্তি' - এটা মনুসংহিতায় সবক্ষেত্রে স্বীকৃত হয়নি l অপরাধীর শাস্তির মাত্রা নির্ধারণে তার জ্ঞানের মাত্রা বিবেচিত হয়েছে এবং একারনেই চৌর্যবৃত্তি বা এজাতীয় ক্ষেত্রে শূদ্র অপেক্ষা ব্রাহ্মণের শাস্তির মাত্রা অধিকতর l রাজা, যিনি রক্ষক তিনিই যদি ভক্ষক হন, তার শাস্তি সর্বাধিক l  মনুষ্যহত্যা বা হত্যার চেষ্টা ইত্যাদি নৃশংস অপরাধের ক্ষেত্রে অবশ্য এই নীতি প্রযোজ্য নয়  l প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, কোন ব্রাহ্মণ কাউকে হত্যা করতে উদ্যত হলে আত্মরক্ষায় সেই আততায়ী ব্রাহ্মণকে হত্যার বিধান মনুসংহিতায় আছে এবং সেই ব্রাহ্মণ হত্যায় আত্মরক্ষাকারীর কোন অধর্ম হবে না (অন্যান্য বর্ণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ) l (মনু : ৮/৩৫০-৩৫১)


*  সাম্যতা


এমনতর অনেকে বলেন বা মনে করেন, প্রাচীন হিন্দু সমাজে শূদ্রগণের বেদপাঠের অধিকার ছিল না l এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত l যজুর্বেদ বলছে,


যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানি জনেভ্যঃ ।

ব্রহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায় চ।।

প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ, ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু ।। ( যজুর্বেদ, ২৬/২)


যার ভাবানুবাদ, হে মনুষ্যগণ আমি যে রূপে ব্রাক্ষণ ,ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র, এবং অন্যান্য সমস্ত জনগনকে এই কল্যাণদায়িনী পবিত্র বেদবাণী বলিতেছি , তোমরাও সেই রূপ কর। বেদবাণীর উপদেশ প্রদাণে যেমন আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি , তোমরাও সেইরূপ হও, সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক l ( স্বামী বেদানন্দ )


 উপনিষদের পঠনপাঠন একজন সন্ন্যাসীর ন্যায় গৃহস্থগণও চর্চা এবং সুফল লাভ করতে পারেন l মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে,


ব্রহ্মনিষ্ট গৃহস্থ: স্যাৎ তত্ত্বজ্ঞানপরায়ণ:l

যদ্ কর্ম প্রকুর্বিত তদ্ ব্রহ্মণি সমর্পয়েৎ ll (যুধিষ্ঠির গোপ : পৃ : ৫)


 মনুসংহিতাও একইভাবে ব্যবহারিক এবং আধ্যাত্মিক উভয়ক্ষেত্রেই সাম্যতার তথা সকল মানুষের সমাধিকারে বিশ্বাসী l এ সম্পর্কে মনুসংহিতার নিমরূপ বিধানগুলি প্রণিধানযোগ্য l


বিদ্যা যদি মঙ্গলজনক হয়, শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে শূদ্রের নিকট থেকেও তা গ্রহণ করবে l অন্ত্যজের নিকট থেকেই পরম ধর্ম এবং আপনার অপেক্ষা নিকৃষ্ট কুল থেকেও উত্তম স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করিবেন l (মনু : ২/২৩৮)


স্ত্রী, রত্ন, বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতকথা এবং বিবিধ শিল্পকার্য - এই গুলি সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে l (মনু : ২/২৪০)


ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারী আপৎকালে অব্রাহ্মণের নিকট অধ্যয়ন করতে পারেন এবং যতদিন অধ্যয়ন করবেন ততদিন পর্যন্ত অনুগমন প্রভৃতির দ্বারা শুশ্রুষা করবেন l  (মনু : ২/২৪১)


মনুসংহিতার উল্লিখিত বিধান জ্ঞানার্জন, শিক্ষাদান, বিবাহ হতে সামাজিক সকল ক্ষেত্রে বেদবর্ণিত সামাজিক সাম্য এবং অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয় l


* নীতিধর্ম


অহিংসা, সত্যকথন, অচৌর্য, শুচিত্ব ও ইন্দ্রিয় সংযম এইসকল ধর্ম চতুর্বর্ণের পালনীয় l ( মনু: ১০/ ৬৪)


যাঁর বাক্য ও মন শুদ্ধ, যিনি বাক্য ও মনকে নিষিদ্ধ কর্ম থেকে সর্বদা সম্যকভাবে রক্ষা করেন, তিনি বেদান্তশাস্ত্র উক্ত সকল ফলই লাভ করেন l (মনু সংহিতা: ২/১৬০)


নিজে নিতান্ত পীড়িত হলেও মর্মপীড়া দিতে নেই ; পরের অনিষ্ট হয় তেমন কোন কর্ম বা চিন্তা করতে নেই l (মনুসংহিতা: ২/১৬১)


ঐহিক সম্মানকে ব্রাহ্মণ চিরজীবন বিষের ন্যায় জ্ঞান করবেন এবং অপমানকে সর্বদা অমৃতের ন্যায় আকাঙ্খা করবেন l (মনুসংহিতা: ২/১৬২)


ক্ষমাশীলতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে l (৫/১০৭)


পিতা, মাতা এবং আচার্য এই তিনজনের সেবাকেই "পরম  তপস্যা" বলা হয়েছে l "ত্রি বেদ', " তিন লোক " এর অভিন্ন বলা হয়েছে l ( মনু : ২/২২৮ - ২৩০)


উল্লিখিত বিধানে যে উদার উচ্চতর নৈতিক মূল্যবোধ বর্ণিত হয়েছে, তা বলাবাহুল্য l জ্ঞানযোগের সাথে কর্মযোগকে সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে l বেদজ্ঞান ব্যতিরেকে একজন স্বার্থহীনভাবে কর্তব্য পালন করলেও উচ্চতর ( আধ্যাত্মিকতার নিরিখে ) স্থানে পৌঁছতে পারে, এমন মত দেওয়া হয়েছে l


 এই সকল বিধানে যে মানবিকতা কথিত হয়েছে, ঠিক এর বিপরীতধর্মী বহু বিধান মনুসংহিতাতে রয়েছে, যা আমরা এই লেখার সূচনাতেই উল্লেখ করেছি l প্রশ্ন হল, একই গ্রন্থে এই চরম স্ববিরোধিতা কেন? একই শাস্ত্রকার কিভাবে স্বয়ং এতদ্ আত্মবিরোধিতা করেছেন? মনুসংহিতায় যে জাতিবৈষম্যমূলক বা লিঙ্গবৈষম্যমূলক বা সার্বিকরূপে অবদমনমূলক বিধানগুলি রয়েছে, সেগুলি বাস্তবে বিকৃতি বা গোঁজ, যেগুলি গুঁজে দেওয়া হয়েছে মনুসংহিতায়, মানবিক একটি শাস্ত্রকে অমানবিক ও বিভেদকামী রূপান্তরের স্বার্থে l ওই বিকৃতিগুলির কোনটিই মনুসংহিতার বিধান নয়, হতেই পারেনা l কেন হতে পারে না, এর উত্তর রয়েছে স্বয়ং মনুসংহিতাতে এবং বৈদিকশাস্ত্র গঠনতন্ত্রে l

  

"মনুসংহিতা" আসলে কি? এটি একটি বৈদিক ধর্মশাস্ত্র  অর্থাৎ বেদাশ্রিত বা বেদানুমোদিত সমাজ পরিচালন ব্যবস্থার  কর্তব্যবিধি l বেদই মনুসংহিতার ভিত্তিভূমি - 'বেদার্থোপনিবদ্ধাত্বাৎ  প্রাধান্যম্ তু মনো: স্মৃতম্ ' l ( শ্রী মুরারিমোহন শাস্ত্রী, পৃ: ১) l


মনুসংহিতা বলছে,


যে সকল স্মৃতি বেদমূলক নয় এবং বেদবিরুদ্ধ, সে সব পরলোকে ফলদায়ক হয় না বরং নরক ফলদায়ক হয়ে থাকে l ( মনু :  ১২/৯৫)


চতুর্বর্ণ, ত্রিলোক, চতুরাশ্রম, ভূত- ভবিষ্যৎ- বর্তমান  - এ সকলই বেদ হতেই প্রসিদ্ধ হয়েছে l ( মনু : ১২/৯৭)


উল্লিখিত শ্লোকদুটির বক্তব্য,  ব্যবহারিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনের মূল ধারণা এবং তদানুযায়ী যে কর্তব্যকর্ম স্মৃতিতে বিধানরূপে উল্লেখ থাকবে, তা অবশ্যই বেদের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে l বেদের রীতি বা ধারণার সাথে অসংগতিপূর্ণ কোনকিছুই স্মৃতিতে থাকতে পারবে না l নারীর বিবিধ অধিকার সহ, গুণপ্রসূত কর্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্যহীনতা - এ সকলই বেদের প্রতিপাদ্য l  বৈদিক এই উদার চিন্তাধারার সাথে সংগতিপূর্ণ বিধানই কেবলমাত্র বৈদিক স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানরূপে গণ্য, বেদের সাথে অসংগতিপূর্ণ কোন বিধানই স্মৃতির বিধান রূপে গণ্য নয় l বিষয়টি সহজভাবে বোঝা যাক, বর্তমান ভারতবর্ষে রাষ্ট্রপরিচালনব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে ভারতীয় সংবিধান l আইনপ্রণেতাগণ সমাজের স্বার্থে নব আইন প্রণয়ণ করতে পারেন কিম্বা পুরোনো আইন সংশোধন করতে পারেন কিন্তু যে আইনই তাঁরা বলবৎ করুক' না কেন, সেটিকে অবশ্যই সংবিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে, অন্যথায় তা হয়ে যাবে অবৈধ এবং শূন্যগর্ভ l  একই যুক্তিতে বৈদিক ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিতে যদি বেদবিরোধী বিধান থাকে, সেই বিধান অবৈধ এবং শূন্যগর্ভ বলে গণ্য হবে l উল্লেখ্য, ক্ষেত্রবিশেষে সংবিধান সংশোধন সম্ভব কিন্তু বেদের মূলদর্শন বা ভাবনার পরিবর্তন সম্ভব নয় l হিন্দু শাস্ত্রের গঠনতন্ত্র প্রসঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ব্যাসদেবকে অনুসরণ করে বলছেন,


Where variance is observed between the Veda, the Smriti and the Purana, there the Veda is the Supreme authority; when the Smriti and the Purana contradict each other, the Smriti is the superior authority. (Iswarachandra Vidyasagar, পৃ : ১৯)


বৈদিকশাস্ত্রসমূহ একটি সুসংবদ্ধ তন্ত্রের অধীন l বৈদিক শাস্ত্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে শ্রুতি (বেদ), তার নীচে স্মৃতি এবং তার নীচে পুরাণ ও অন্যান্য l বৈদিকশাস্ত্র মাত্রেই এই তন্ত্র (system) এর অধীন l কাজেই স্মৃতি বা পুরাণ, তাতে যে বিধান বা কর্তব্যকর্ম বা নীতি ঘোষিত বা বর্ণিত হোক'না কেন,  বেদবিরোধী হলে তা কখনই বৈদিক রূপে বিবেচিত হতে পারবে না l বেদের  মহাবাক্য ( 'প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম', ' তৎ ত্বম অসি', ''অহং ব্রহ্মাস্মি', 'অয়ং আত্মা ব্রহ্ম' প্রভৃতি ) মাত্রই সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' অর্থাৎ  এই সবই ব্রহ্ম ( All in One ) ধারণার জ্ঞাপক l  বেদের যাবতীয় স্তোত্র ও মন্ত্র সেই লক্ষ্যাভিমুখী l বৈদিক দর্শনের এই আধ্যাত্মিক বীক্ষাই প্রকাশ পায় বেদের ব্যবহারিক বা জাগতিক ভাবনায়, যাকে সাংসারিক জীবনে বাহ্যিক রূপরেখা দিতে সৃষ্টি হয়েছে বৈদিক ধর্মশাস্ত্র তথা স্মৃতি l স্মৃতির বিধান কখনই বেদের অন্তর্নিহিত দার্শনিক চেতনা বা নীতির সাথে অসংগতিপূর্ণ হতে পারবে না l ফলস্বরূপ, বৈদিক ধৰ্মশাস্ত্রে অবদমনমূলক বা বিদ্বেষমূলক কোন বাক্য থাকতেই পারবে না, কারন, বেদ তা অনুমতি দেয় না l মনুসংহিতা সহ সকল ধর্মশাস্ত্রে যে পক্ষপাতমূলক বা বিভেদমূলক বচন আছে, তা সবই বিকৃতি l


ধর্মশাস্ত্রগুলি সৃষ্টির সময়ে এই বিকৃতি সম্ভবই ছিল না l প্রবল যুক্তিবাদ ছিল এর কারন l প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে তৎপর্য্য বিশ্লেষণ করা হতো l এ বিষয়ে বৈদিক ঋষিগণের মধ্যে পারস্পরিক বিচার বিশ্লেষণ অনবরত চলতো l সেটাই ছিল নিয়ম l কাজেই তৎকালীন সময়ে বৈদিক ধৰ্মশাস্ত্রে সম্পূর্ণ বেদবিরোধী বা বেদের ধারণা বিরোধী বিধান সম্ভবই ছিলনা l এই বিকৃতি ঘটে পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে l বিগত এক সহস্র বৎসর ও তার কয়েক শতাব্দী পূর্ব হতে ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনে যে অস্থিরতা তৈরী হয়েছিল, তার কুপ্রভাব খুব স্বাভাবিক ভাবেই আবহমান কাল ধরে চলে আসা ভারতীয় সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনেও গভীরভাবে পড়েছিল l অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ভক্তি আন্দোলন ধারাবাহিকবিগত এই সময়কালে গড়ে উঠতে থাকে, রাজা রামমোহন - বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজ ও ধর্ম সংস্কারগণের ইতিহাস বিগত দুই -তিন শতকের l ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া বা বাদ - বিসম্বাদ থেকে মনে হয় বিগত একসহস্রকালের ইতিহাস গভীরভাবে অনুশীলন যদি সম্ভব হয়, ধৰ্মশাস্ত্রের বিকৃতির একটা ধারণা হয়তো পাওয়া যেতে পারে l 


এটা দুর্ভাগ্য যে, যারা মনুসংহিতার বিধান দেখিয়ে উচ্চনীচ বিভাজনকে মান্যতা দিয়ে একশ্রেণীর মানুষকে অবদমিত রাখতে চায় এবং যারা মনুসংহিতা অমানবিক এই ধারণা পোষণ করে, সকলেই এই শাস্ত্রটির বিকৃত বিধানকেই প্রাধান্য দেয় l এই শাস্ত্রের মূল সত্য, উদার এবং সাম্যমূলক ভাবনা অন্ধকারেই রয়ে যায় l কৃতিবিকৃতির ঘন কুয়াশায় আবৃত মনুসংহিতা বিভ্রম সৃষ্টি করে l শাস্ত্রটির সংস্কার অতি আবশ্যক l যুক্তির আলোকে বিচার করলে অনাবৃত মনুসংহিতায় বেদানুমোদিত উদারচিন্তা এবং মানবতারই সন্ধান মেলে l বিদ্যাসাগর বলছেন,


Countrymen ! How long will you suffer yourselves to be led away by illusions ! Open your eyes for once and see, that India, once the land of virtue, is being overflooded with the stream of adultery and foeticide.... Dip into the spirit of your Sastras, follow its dictates and you shall be able to remove the foul bolt from the face of your country. (পৃ : ১৩৫)


তথ্যসূত্র :


১. মনু সংহিতা - শ্রী মুরারিমোহন শাস্ত্রী

২. মনুসংহিতা - উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত

৩. Lectures on the Ancient History of India : on the Period from 650 to 325 B. C - D. R. Bhandarkar

৪. The Argumentative Indian - Amartya Sen

৫. Sudra Rulers and Officials in Early Medieval Times' in Proceedings of the Indian History Congress - H. S.Kotiyal

৬. ন্যায়পরিচয় - পন্ডিত মহামোহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ

৭. কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র - ড: অনিল চন্দ্র বসু

৮. বেদ -সংকলন - ড: উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

৯. যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা ( ব্যবহারাধ্যায়:) - ড: অনিলচন্দ্র বসু

১০. ওঁ হিন্দুত্বম্ - স্বামী বেদানন্দ

১১. Marriage of Hindu Widows - Iswarachandra Vidyasagar

১২. ঈশোপনিষদ - যুধিষ্ঠির গোপ

১৩. Is Caste System Intrinsic to Hinduism? Demolishing a Myth - M. V. Nadkarni

১৪. Hinduism and Caste - M. V. Nadkarni




No comments:

Post a Comment

  An Introduction of Mahatma Gandhi Introduction: Mahatma Gandhi as a visionary of India had a very clear perception of Indian villages. H...